গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের মাটির ঘরের কদর কমিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক বন্যার ভয়াবহতাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অথচ দিনাজপুর অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত নজরকাড়া একতলা কিংবা দোতলা মাটির বাড়ি। মাটির বাড়িই শুধু নয়, ছিল ধান-চাল রাখার জন্য মাটির তৈরি গোলাঘর ও কুঠি। আকর্ষণীয় এসব মাটির দেয়ালের নকশা এতটাই নিখুঁত সমন্বিত যে প্রথম দেখায় ওয়াল পেপার বা টাইলস বলে ভ্রম হতে পারে। এসব চমৎকার নকশা কোনো পেশাদার কারিগর বা শিল্পীর হাতের কাজ নয় বাড়ির মা-বোনদের মনের ভিতরে যে শৈল্পিক সত্তা লুকিয়ে আছে নিজ হাতে তা ফুটিয়ে তোলেন বাড়িতে তৈরি রং দিয়ে আর সেই সঙ্গে মেশান মনের মাধুরী। আবার মাটির ঘর যাদের আছে তারা প্রতি বছরই মাটির প্রলেপ দেয়। অনেকে আবার চুনকামসহ বিভিন্ন রংও করেন। ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে মাটির ঘরের স্থায়িত্ব শত বছরও হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, সেটেলাইট টিভি চ্যানেলের ক্যাবল লাইন, পাকা সড়ক, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রামের দৃশ্য বদলে দিয়েছে। সামগ্রিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানে উন্নতি লক্ষণীয়। তাই শঙ্কা গ্রামবাংলার চোখ ধাঁধানো এসব ঐতিহ্য আধুনিকতার উগ্র আগ্রাসনে একদিন হারিয়ে যাবে কি? যেমন হারিয়ে গেছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পাড়ায় মাটির দেয়ালে হাতের নকশার কাজ, হারিয়ে গেছে উত্তরের জনপদে গোধূলির লগ্নে সাঁওতালি বাঁশির সুমধুর সুর! তবে দিনে দিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব আজ হারাতে বসেছে।
মাটির ঘর ঠাণ্ডা বলে অনেকে এটাকে গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরও বলত। এ ঘর গরমের সময় আরামদায়ক। তাই অনেক গ্রামেই বিত্তশালীদেরও দোতলা মাটির ঘর ছিল। এখনো এ অঞ্চলের অনেক গ্রামে রয়েছে। তবে দিনাজপুর জেলায় সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় এসব মাটির ঘরের বেশিরভাগই হয় ভেঙে গেছে, না হয় ফেটে গেছে। দরিদ্র পরিবারগুলো আবার ওই মাটির ঘর তৈরি শুরু করেছে, আবার কেউ করবেন। এখানে মাটির সহজলভ্যতা, এর প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় এখানকার মানুষ মাটির তৈরি ঘর বানাতে আগ্রহী বেশি। তবে মানুষ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে এখন ইটের দালান গড়ে তুলছেন।
বিরল উপজেলার পলাশবাড়ী ইউপির হরিপুর গ্রামের রেজাউল ইসলাম জানান, সাধারণত এঁটেল বা আঠালো মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করা হয়। এরপর ২০/৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিটি ঘর তৈরি করতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যায়। কারণ একবারে দেয়াল তোলা যায় না। কিছু দেয়াল তোলার পর শুকাতে হয়। ১০/১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় বা টিনের ছাউনি দেওয়া হয়।
দিনাজপুর সদরের আউলিয়াপুর গ্রামের মোসাদ্দেক হোসেন জানায়, অনেকে বাঁশ, মাটি, টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরি করেন। এ ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগে। তবে খরচ কম পড়ে। শ্রমিক না নিলে কমপক্ষে ১২/১৫ হাজার টাকা খরচ হয়।